কখনো ভেবে দেখেছেন, আপনার মাথায় যে প্রায় দেড় কেজি ওজনের নরম, তুলতুলে বস্তুটি রয়েছে, তা দিয়ে একটি ছোট এলইডি লাইট বাল্ব জ্বালানো সম্ভব? অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটিই বিজ্ঞানসম্মত সত্যি! আমাদের মস্তিষ্ক, ঘুমের গভীরে অচেতন থাকা অবস্থাতেও, প্রতি মুহূর্তে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে চলেছে। এটি যেন আমাদের খুলির ভেতরে অবস্থিত এক জীবন্ত 'পাওয়ার স্টেশন'। চলুন, আজ এই জীবন্ত পাওয়ার স্টেশনের পেছনের গল্প জেনে আসি।
মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক নেটওয়ার্ক
আমাদের মস্তিষ্ক প্রায় ৮৬ বিলিয়ন নিউরন বা স্নায়ুকোষের এক বিশাল এবং জটিল নেটওয়ার্ক। এই নিউরনগুলোকে আপনি সূক্ষ্ম বৈদ্যুতিক তারের এক মহাজালের সাথে তুলনা করতে পারেন। এরা একে অপরের সাথে যোগাযোগের জন্য বৈদ্যুতিক সংকেত বা 'ইলেকট্রিক্যাল ইমপালস' ব্যবহার করে। আমাদের প্রতিটি চিন্তা, অনুভূতি, স্মৃতি এবং নড়াচড়া—সবকিছুর পেছনেই রয়েছে এই বৈদ্যুতিক সংকেতের খেলা।
বিদ্যুৎ তৈরির পেছনের বিজ্ঞান
এই বিদ্যুৎ তৈরির প্রক্রিয়াটা বেশ চমকপ্রদ। আমাদের প্রতিটি নিউরনের কোষ প্রাচীরের (cell membrane) ভেতরে এবং বাইরে সোডিয়াম (Na^+) এবং পটাশিয়াম (K^+) এর মতো আয়ন (চার্জযুক্ত কণা) ভেসে বেড়ায়। স্বাভাবিক অবস্থায়, কোষের ভেতরে পটাশিয়ামের ঘনত্ব বেশি এবং বাইরে সোডিয়ামের ঘনত্ব বেশি থাকে, যা একটি স্থিতিশীল বৈদ্যুতিক বিভব বা 'রেস্টিং পটেনশিয়াল' তৈরি করে।
যখন কোনো সংকেত পাঠানোর প্রয়োজন হয়, তখন নিউরনের কোষ প্রাচীরের নির্দিষ্ট চ্যানেলগুলো খুলে যায়। এর ফলে সোডিয়াম আয়ন খুব দ্রুত কোষের ভেতরে প্রবেশ করে এবং পটাশিয়াম আয়ন বাইরে বেরিয়ে আসে। আয়নের এই দ্রুত চলাচলই একটি ক্ষুদ্র কিন্তু শক্তিশালী বৈদ্যুতিক চার্জ তৈরি করে, যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় 'অ্যাকশন পটেনশিয়াল' (Action Potential)। এটা অনেকটা ছোট্ট একটি বৈদ্যুতিক স্পার্কের মতো, যা এক নিউরন থেকে আরেক নিউরনে তথ্য বয়ে নিয়ে যায়।
মস্তিষ্কে ঠিক কতটা বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়?
একটি একক নিউরন মাত্র প্রায় ৭০ মিলিভোল্ট বিদ্যুৎ তৈরি করে, যা খুবই সামান্য। কিন্তু যখন কয়েক বিলিয়ন নিউরন একসাথে তাদের সংকেত চালাচালি করে, তখন সম্মিলিতভাবে আমাদের মস্তিষ্ক প্রায় ১০ থেকে ২৩ ওয়াট বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন করতে পারে। এই শক্তি দিয়ে অনায়াসে একটি কম আলোর এলইডি বাল্ব, একটি ডিজিটাল ঘড়ি বা এমনকি রেফ্রিজারেটরের ভেতরের বাতিও জ্বালিয়ে রাখা সম্ভব! সুতরাং, আমাদের মস্তিষ্ক কেবল একটি সুপার কম্পিউটারই নয়, এটি তার নিজস্ব পাওয়ার সাপ্লাই দিয়ে সক্রিয় থাকে।
বিজ্ঞানের চোখে মস্তিষ্কের বিদ্যুৎ
এই বিষয়টি কোনো কল্পকাহিনী নয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই ವಿದ್ಯুতের বাস্তব প্রয়োগ রয়েছে। 'ইলেক্ট্রোএনসেফালোগ্রাম' বা EEG নামক একটি পরীক্ষার মাধ্যমে মাথায় বিশেষ ইলেক্ট্রোড লাগিয়ে মস্তিষ্কের এই বৈদ্যুতিক কার্যকলাপ পরিমাপ ও রেকর্ড করা হয়। মৃগীরোগ (Epilepsy), ঘুমের সমস্যা (Sleep Disorders), মস্তিষ্কের আঘাত (Brain Injury) এবং অন্যান্য স্নায়ুবিক রোগ নির্ণয়ে EEG একটি অপরিহার্য প্রযুক্তি। এটি আমাদের মস্তিষ্কের ভেতরের বৈদ্যুতিক তরঙ্গের একটি জীবন্ত চিত্র তুলে ধরে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা: ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস
মস্তিষ্কের এই বৈদ্যুতিক সংকেত নিয়ে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় গবেষণা কেন্দ্রগুলোতে চলছে যুগান্তকারী গবেষণা। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির উ সাই নিউরোসায়েন্সেস ইনস্টিটিউট (Wu Tsai Neurosciences Institute)-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এই গবেষণায় নেতৃত্ব দিচ্ছে। তাদের একটি বড় লক্ষ্য হলো 'ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস' (Brain-Computer Interface বা BCI) তৈরি করা।
BCI এমন এক প্রযুক্তি যা মানুষকে শুধুমাত্র চিন্তা ব্যবহার করে কম্পিউটার, রোবোটিক হাত, বা কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা দেবে। পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিরা একদিন হয়তো কেবল ভেবেই তাদের হুইলচেয়ার চালাতে পারবেন বা কোনো কিছু টাইপ করতে পারবেন। এই প্রযুক্তির ভিত্তি হলো মস্তিষ্কের তৈরি করা বিদ্যুৎকে শনাক্ত করে সেটিকে ডিজিটাল কমান্ডে রূপান্তর করা।
শেষ কথা
সুতরাং, পরেরবার যখন নিজেকে ক্লান্ত বা 'সাধারণ' ভাববেন, তখন একবার মনে করবেন—আপনার খুলির ভেতরেই একটি বায়োলজিক্যাল সুপারকম্পিউটার চলছে, যা একটি নিজস্ব পাওয়ার সাপ্লাই দিয়ে নিরন্তর সক্রিয়। আমাদের মস্তিষ্ক প্রকৃতির এক অবিশ্বাস্য সৃষ্টি, যা এখনো বিজ্ঞানীদের কাছে বিস্ময়ের এক অফুরন্ত উৎস।
আপনার কী মনে হয়, ভবিষ্যতে আমরা কি মস্তিষ্ককে সরাসরি কোনো ডিভাইসের পাওয়ার ব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করতে পারব? আপনার ভাবনা কমেন্টে জানান! 👇
তথ্যসূত্র:
* Buzsáki, G., & Watson, B. O. (2012). Brain rhythms and neural syntax: implications for efficient coding of cognitive content and neuro-psychiatric disorders. Dialogues in clinical neuroscience, 14(4), 345–367.
* Stanford University. (n.d.). Wu Tsai Neurosciences Institute. Retrieved from https://neuroscience.stanford.edu/
* Society for Neuroscience. (2021). Brain Facts: A Primer on the Brain and Nervous System.
* Herculano-Houzel, S. (2009). The human brain in numbers: a linearly scaled-up primate brain. Frontiers in Human Neuroscience, 3, 31.
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)
১. মানব মস্তিষ্ক কি সত্যিই বিদ্যুৎ তৈরি করে?
উত্তর: হ্যাঁ, মানব মস্তিষ্ক সত্যিই বিদ্যুৎ তৈরি করে। আমাদের মস্তিষ্কে থাকা প্রায় ৮৬ বিলিয়ন নিউরন বা স্নায়ুকোষ একে অপরের সাথে যোগাযোগের জন্য ক্ষুদ্র বৈদ্যুতিক সংকেত ব্যবহার করে, যাকে 'অ্যাকশন পটেনশিয়াল' বলা হয়। এই সম্মিলিত বৈদ্যুতিক কার্যকলাপই মস্তিষ্ককে একটি জীবন্ত জৈব-বৈদ্যুতিক যন্ত্রে পরিণত করে।
২. মস্তিষ্ক কত ওয়াট বিদ্যুৎ শক্তি উৎপন্ন করতে পারে?
উত্তর: একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মস্তিষ্ক যখন সক্রিয় থাকে, তখন এটি প্রায় ১০ থেকে ২৩ ওয়াট বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন করতে পারে। এই পরিমাণ শক্তি একটি কম আলোর এলইডি (LED) বাল্ব বা একটি রেফ্রিজারেটরের ভেতরের বাতি জ্বালিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট।
৩. EEG পরীক্ষা কী এবং এটি কীভাবে কাজ করে?
উত্তর: EEG বা 'ইলেক্ট্রোএনসেফালোগ্রাম' হলো একটি পরীক্ষা যার মাধ্যমে মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক কার্যকলাপ পরিমাপ করা হয়। এই পরীক্ষায় মাথার ত্বকে ছোট ইলেক্ট্রোড লাগানো হয়, যা নিউরন দ্বারা উৎপাদিত বৈদ্যুতিক তরঙ্গ শনাক্ত ও রেকর্ড করে। মৃগীরোগ, ঘুমের সমস্যা এবং মস্তিষ্কের অন্যান্য অস্বাভাবিকতা নির্ণয় করতে ডাক্তাররা এই পরীক্ষাটি ব্যবহার করেন।
৪. ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস (BCI) প্রযুক্তি কী?
উত্তর: ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস (BCI) হলো এমন একটি প্রযুক্তি যা মস্তিষ্ক এবং একটি বাহ্যিক ডিভাইস (যেমন- কম্পিউটার বা কৃত্রিম অঙ্গ) এর মধ্যে সরাসরি যোগাযোগের পথ তৈরি করে। এটি মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক সংকেত শনাক্ত করে সেগুলোকে ডিজিটাল কমান্ডে রূপান্তর করে, যার ফলে ব্যবহারকারীরা শুধুমাত্র চিন্তা করেই ডিভাইস নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।
৫. নিউরন কীভাবে বৈদ্যুতিক সংকেত তৈরি করে?
উত্তর: নিউরনগুলো সোডিয়াম এবং পটাশিয়ামের মতো চার্জযুক্ত কণা বা আয়নের চলাচল ব্যবহার করে বৈদ্যুতিক সংকেত তৈরি করে। যখন একটি নিউরনকে উদ্দীপিত করা হয়, তখন এর কোষ প্রাচীরের চ্যানেলগুলো খুলে যায় এবং আয়নের প্রবাহে পরিবর্তন আসে। এই আয়নের দ্রুত চলাচল একটি ক্ষুদ্র বৈদ্যুতিক চার্জ বা 'অ্যাকশন পটেনশিয়াল' তৈরি করে, যা এক নিউরন থেকে অন্য নিউরনে তথ্য প্রেরণ করে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন