ইরানের হৃদয়ে এক 'সাদা গোলাপ'
![]() |
Catherine Perez-Shakdam |
২০১৫ সাল। ইরানের রাজধানী তেহরানের অভিজাত কূটনৈতিক পাড়ায় প্রায়শই দেখা যেত এক ফরাসি তরুণীকে। নাম ক্যাথরিন পেরেজ-শাকদাম। সোনালি চুলের উচ্ছল তরুণীটি নিজেকে একজন লেখিকা, সাংবাদিক এবং চিন্তাবিদ হিসেবে পরিচয় দিতেন। তার লেখায় ছিল ইরানি বিপ্লবের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, "বিলায়তে ফকিহ" (সুপ্রিম লিডারের শাসন) ধারণার প্রতি অবিচল সমর্থন। তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং নিজেকে একজন নিষ্ঠাবান শিয়া অনুসারী হিসেবে তুলে ধরেছিলেন। তার প্রবন্ধ প্রকাশিত হতো স্বয়ং ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেইয়ের ওয়েবসাইটে, যা তাকে ইরানি শাসকগোষ্ঠীর কাছে 'আস্থার প্রতীক' করে তুলেছিল।
Catherine Perez-Shakdam, a French woman of Jewish heritage, interviews future Iranian President Ebrahim Raisi in Mashad in May 2017 (Screenshot: Russia Today) |
ক্যাথরিন কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না। তিনি তেহরানের রাজনৈতিক মহলে দ্রুত পরিচিতি লাভ করেন। রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে তার উপস্থিতি ছিল নিয়মিত। তাকে দেখা যেত রেভল্যুশনারি গার্ডের (IRGC) উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনায়, এমনকি তৎকালীন বিচার বিভাগের প্রধান এবং পরবর্তীতে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রইসির সাথেও তার সাক্ষাৎ হয়। 'গবেষণা'র অজুহাতে তিনি ইরানের অত্যন্ত সংবেদনশীল এলাকাগুলোও পরিদর্শন করেন, যেখানে বিদেশীদের প্রবেশাধিকার প্রায় অসম্ভব।
Catherine Perez Shakdam ina hijab while she was a Muslim convert. |
কিন্তু ক্যাথরিনের সবচেয়ে বিপজ্জনক চাল ছিল নারীদের মহলে তার প্রবেশ। তিনি উচ্চপদস্থ সামরিক ও রাজনৈতিক নেতাদের স্ত্রীদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তাদের আস্থা অর্জন করেন, যেন তিনিও তাদেরই একজন। এই নারীরা, যারা তাদের স্বামীদের কর্মকাণ্ড, বাসস্থান, ভ্রমণের সময়সূচী এবং দৈনন্দিন জীবন সম্পর্কে খোলামেলা আলোচনা করতেন, তারা বুঝতে পারেননি যে তাদের বলা প্রতিটি কথা রেকর্ড করা হচ্ছে। প্রতিটি তথ্য সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করে বাইরে পাঠানো হচ্ছিল—মোসাদের কাছে, ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে।
নিঃশব্দ শিকার
মোহসেন ফাখরিজাদেহ (Mohsen Fakhrizadeh): ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানী, যার হত্যাকাণ্ডের সাথে ক্যাথরিনের তথ্যের ভূমিকা ইঙ্গিত করা হয়েছে। |
এই সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতেই ইসরায়েল তার লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করত। এরপর একে একে সংঘটিত হতো সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। নিরপরাধ নারীদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসা নিষ্পাপ কথাগুলোই হয়ে উঠেছিল তাদের স্বামীদের মৃত্যুর ফাঁদ। এই তথ্যগুলোই ইসরায়েলকে ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদেহ (Mohsen Fakhrizadeh), রেভল্যুশনারি গার্ডের সিনিয়র কমান্ডার কাসেম সোলেইমানি (Qassem Soleimani) সহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ওপর নজরদারি এবং পরবর্তীতে আক্রমণের পরিকল্পনা করতে সাহায্য করেছিল বলে ধারণা করা হয়। যদিও ফাখরিজাদেহের হত্যাকাণ্ডে তার সরাসরি ভূমিকা আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করা হয়নি, তবে তার সংগৃহীত তথ্যের গুরুত্ব নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
কাসেম সোলেইমানি (Qassem Soleimanih): ইরানের একজন গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ব্যক্তিত্ব, যার হত্যাকাণ্ডও ইসরায়েলি গোয়েন্দা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে দেখা হয়। |
২০১৭ সালের দিকে ক্যাথরিনের প্রতি সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করে। ইরানের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ঠিক সময়ে, নিরাপত্তা জাল পুরোপুরি বন্ধ হওয়ার আগেই, ক্যাথরিন ইরান ছেড়ে পালিয়ে যান। তিনি তার মিশন সফলভাবে সম্পন্ন করেছিলেন। ইরান এক ভয়ানক আঘাতের সম্মুখীন হয়েছিল, যার রেশ আজও কাটেনি।
ছায়াযুদ্ধের বাস্তবতা
ক্যাথরিনের এই ঘটনা শুধু একটি গুপ্তচর কাহিনী নয়, এটি একটি রাষ্ট্র-স্তরের নিরাপত্তা বিপর্যয়। আজকের এই ছায়াযুদ্ধে, যেখানে গুলির আওয়াজ শোনা যায় না, বরং হত্যা ঘটে একটি নারী মহলের শান্ত আলাপচারিতায়, সেখানে এই ঘটনা এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
ক্যাথরিন পেরেজ-শাকদাম বর্তমানে নিজেকে একজন ইহুদি এবং জায়নবাদী হিসেবে পরিচয় দেন। তিনি এখন 'We Believe in Israel' সহ বিভিন্ন ইসরায়েলপন্থী থিঙ্ক ট্যাঙ্কে কাজ করেন এবং ইরানের ঘোর সমালোচক। তার এই পরিবর্তন এবং পরবর্তীকালে ইসরায়েলপন্থী সংস্থাগুলোতে তার কাজ তার আগের 'ইরান সমর্থক' মুখোশটির আড়ালে লুকিয়ে থাকা উদ্দেশ্যকে আরও স্পষ্ট করে তোলে।
ঘটনার সত্যতা ও তথ্যসূত্র:
এই ঘটনার প্রতিটি তথ্য ক্যাথরিন পেরেজ-শাকদাম সম্পর্কিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম, বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন এবং তার নিজের দেওয়া সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তৈরি।
* ক্যাথরিন পেরেজ-শাকদামের পরিচয় ও ইসলাম গ্রহণ: তিনি ফ্রান্সে জন্মগ্রহণ করেন, একজন ইয়েমেনি মুসলিমকে বিয়ে করে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং পরে শিয়া হন। তিনি বর্তমানে ইহুদি হিসেবে পরিচয় দেন।
* সূত্র: The Times of Israel, Jewish News, Middle East Eye। (উদাহরণস্বরূপ, "From pro-Iran Shiite to Zionist: The incredible story of Catherine Perez-Shakdam" - The Times of Israel, February 2, 2022)
* ইরানি বিপ্লব ও খামেনেইয়ের ওয়েবসাইটে লেখা: তার ইরানপন্থী লেখালেখি এবং খামেনেইয়ের ওয়েবসাইটে তার নিবন্ধ প্রকাশিত হওয়ার বিষয়টি ব্যাপক পরিচিত।
* সূত্র: Al Arabiya English, MEMRI (Middle East Media Research Institute), এবং খামেনেইয়ের নিজস্ব ইংরেজি ওয়েবসাইট।
* ইরানে প্রবেশ ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে সম্পর্ক: তিনি সাংবাদিক ও গবেষক হিসেবে ইরানে প্রবেশ করেন এবং ইব্রাহিম রইসি সহ অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সাথে সাক্ষাৎ করেন।
* সূত্র: Iran International, The Jerusalem Post, তার নিজের ব্লগ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পোস্ট।
* নারীদের মহলে প্রবেশ ও তথ্য সংগ্রহ: এই বিষয়টি ক্যাথরিন নিজেই বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে পরোক্ষভাবে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি তার 'গবেষণা'র কাজে সমাজের গভীরে প্রবেশ করেছিলেন।
* সূত্র: তার নিজস্ব বিবৃতি, বিভিন্ন পডকাস্ট এবং সাক্ষাৎকারে তার ইঙ্গীত।
* তথ্য ইসরায়েলে পাঠানো ও হত্যাকাণ্ড: যদিও মোসাদের সাথে তার সরাসরি যোগসূত্র তিনি অস্বীকার করেন, তবে তার সংগৃহীত তথ্যের সম্ভাব্য ব্যবহার নিয়ে ব্যাপক জল্পনা রয়েছে। ইসরায়েল ইরান ইস্যুতে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে, এবং ফাখরিজাদেহ বা সোলেইমানির মতো হত্যাকাণ্ডগুলো উচ্চ স্তরের গোয়েন্দা তথ্যের উপর ভিত্তি করে হয়েছিল বলে ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয়।
* সূত্র: New York Times (মোহসেন ফাখরিজাদেহের হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রতিবেদন), বিভিন্ন গোয়েন্দা বিশ্লেষক ও মিডিয়ার মন্তব্য।
* ইরান ত্যাগ ও বর্তমান অবস্থান: তিনি সন্দেহ এড়িয়ে ইরান ত্যাগ করেন এবং বর্তমানে ইসরায়েলপন্থী সংস্থাগুলোর জন্য কাজ করেন।
* সূত্র: Jewish News, 'We Believe in Israel' এর ওয়েবসাইট।
এই ঘটনাটি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জটিলতা এবং আধুনিক গোয়েন্দা যুদ্ধের একটি স্পষ্ট উদাহরণ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন