মাইলস্টোন কলেজের ট্র্যাজেডি: প্রত্যক্ষদর্শী, হতাহতের তালিকা ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

মাইলস্টোন কলেজের ট্র্যাজেডি: প্রত্যক্ষদর্শী, হতাহতের তালিকা ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

মাইলস্টোন কলেজের ট্র্যাজেডি: প্রত্যক্ষদর্শী, হতাহতের তালিকা ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

মাইলস্টোন কলেজে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর উদ্ধারকাজ চলছে

দুর্ঘটনাস্থলে আগুন ও ধোঁয়ার কুণ্ডলী, যা পুরো এলাকাকে শোকস্তব্ধ করে দেয়।

গতকাল, ২১ জুলাই ২০২৫, সোমবার, দুপুর আনুমানিক ১টা ১৮ মিনিটে, একটি বিভীষিকাময় মুহূর্তের সাক্ষী হলো বাংলাদেশ। রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকায় অবস্থিত মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে দেশের ইতিহাসে এক বেদনাময় অধ্যায়ের জন্ম দিয়েছে। এই ব্লগে আমরা সেই মর্মান্তিক ঘটনার বিস্তারিত, প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান, হতাহতের তালিকা এবং এর আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া তুলে ধরব।

কী ঘটেছিল সেই ভয়াল দুপুরে?

আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর এফ-৭ বিজিআই মডেলের একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান সোমবার দুপুর ১টা ৬ মিনিটে কুর্মিটোলার এ কে খন্দকার ঘাঁটি থেকে উড্ডয়ন করে। উড্ডয়নের মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই বিমানটিতে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয় এবং পাইলট নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার বিষয়টি কন্ট্রোল টাওয়ারকে জানান।

প্রত্যক্ষদর্শী ও আহতদের বয়ান: এক মুহূর্তের বিভীষিকা

ঘটনার আকস্মিকতায় স্তম্ভিত হয়ে যান প্রত্যক্ষদর্শীরা। ভবনের পাশের এক দোকানদার বলেন, "প্রচণ্ড একটি শব্দ শুনে বাইরে এসে দেখি দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে আর মানুষের আর্তনাদ। মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু যেন বিষাদময় হয়ে গেল।"

ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন দশম শ্রেণির ছাত্র মাহিন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে, "আমরা ক্লাসে ছিলাম। হঠাৎ বিস্ফোরণের মতো শব্দ হয় আর ছাদের অংশ ভেঙে পড়তে শুরু করে। আগুন আর ধোঁয়ায় কিছুই দেখতে পারছিলাম না। কীভাবে বেঁচে ফিরেছি, জানি না।"
ফায়ার সার্ভিস ও সেনাবাহিনী উদ্ধারকাজ চালাচ্ছে

দুর্ঘটনার পর দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার অভিযান শুরু করে ফায়ার সার্ভিস ও সশস্ত্র বাহিনী।

ক্ষয়ক্ষতি, হতাহত ও নিখোঁজের তালিকা

এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় ব্যাপক প্রাণহানি ঘটেছে। আইএসপিআর এবং হাসপাতাল সূত্র অনুযায়ী, হতাহত ও নিখোঁজদের একটি প্রাথমিক তালিকা নিচে দেওয়া হলো (এই তালিকা সময়ের সাথে আপডেট হতে পারে)।

নিহতদের তালিকা (প্রাথমিক)

  • ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম (পাইলট)
  • শামীম ইউসুফ (শিক্ষার্থী, ১৪)
  • মুনতাহা (শিক্ষার্থী, ১১)
  • মেহেরিন (শিক্ষার্থী, ১২)
  • আবিদ হাসান (শিক্ষার্থী, ১৭)
  • (অশনাক্ত আরও ১৫ জন)

আহতদের তালিকা (আংশিক)

ঢাকা মেডিকেল কলেজ বার্ন ইউনিট, সিএমএইচ এবং উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে ১৭১ জনেরও বেশি চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এদের মধ্যে রফি বড়ুয়া (২১), মাহিন (১৫), এবং আরও অনেক শিক্ষার্থীর অবস্থা আশঙ্কাজনক।

নিখোঁজদের তালিকা

দুর্ঘটনাস্থল থেকে এখনও পর্যন্ত ৫ জন শিক্ষার্থী নিখোঁজ রয়েছে বলে তাদের পরিবার দাবি করেছে। উদ্ধারকারী দল তাদের সন্ধান অব্যাহত রেখেছে।

জাতির বীর সন্তান: পাইলট তৌকির ইসলাম

এই ট্র্যাজেডির মাঝেও বীরত্বের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম। তিনি নিজের জীবন দিয়ে বাঁচিয়ে দিয়েছেন অগণিত মানুষের প্রাণ।

ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম

ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম

তৌকির ইসলাম বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একজন মেধাবী ও দক্ষ পাইলট হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি বিমানটিকে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে জনবিরল স্থানে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তার এই আত্মত্যাগের কারণেই আরও বড় বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হয়েছে। জাতি তাকে চিরদিন স্মরণ করবে।

দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

এই ঘটনায় সরকার মঙ্গলবার (২২ জুলাই) একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন করছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। পাশাপাশি বিশ্ব নেতারাও এই মর্মান্তিক ঘটনায় শোক জানিয়েছেন।

  • ভারত: প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী শোকবার্তায় নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন।
  • জাপান: জাপান সরকার দুর্ঘটনায় হতাহতদের জন্য গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছে।
  • যুক্তরাষ্ট্র: ঢাকায় অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস এক বিবৃতিতে শোক প্রকাশ করেছে।
  • জাতিসংঘ: জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এই ঘটনায় শোক প্রকাশ করে বাংলাদেশের পাশে থাকার বার্তা দিয়েছেন।
  • তুরস্ক ও পাকিস্তান: তুরস্ক ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধানরাও পৃথক বার্তায় শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন।

বিশ্বের চোখে এই ট্র্যাজেডি

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো এই দুর্ঘটনাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে প্রচার করছে। বিবিসি, সিএনএন, আল জাজিরা, এবং রয়টার্স-এর মতো সংবাদ সংস্থাগুলো দুর্ঘটনার ভয়াবহতা, পাইলটের বীরত্ব এবং বাংলাদেশের বিমান নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। তারা পাইলটের শেষ মুহূর্তের heroic প্রচেষ্টার প্রশংসা করার পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পুরানো প্রশিক্ষণ বিমানের ব্যবহারজনিত ঝুঁকি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে।

সম্ভাব্য কারণ ও চলমান তদন্ত

প্রাথমিকভাবে যান্ত্রিক ত্রুটিকে কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও, বিমানবাহিনী একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তদন্ত শেষে দুর্ঘটনার আসল কারণ জানা যাবে। এই ঘটনাটি দেশের বিমান নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে নতুন করে পর্যালোচনার সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে।

উপসংহার: শোক থেকে শক্তির পথে

মাইলস্টোন কলেজের এই দুর্ঘটনা পুরো জাতির হৃদয়ে এক গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে। এই শোককে শক্তিতে পরিণত করে, দুর্ঘটনার সঠিক কারণ অনুসন্ধান এবং ভবিষ্যতে যেন এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে, তা নিশ্চিত করাই হবে নিহতদের প্রতি আমাদের শ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধা।

তথ্যসূত্র

১. প্রথম আলো: মাইলস্টোন কলেজে বিমান বিধ্বস্ত, বহু হতাহতের আশঙ্কা ২. আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এর প্রেস বিজ্ঞপ্তি ৩. The Daily Star: Pilot hailed as hero for steering crippled jet away from buildings ৪. বিবিসি বাংলা: ঢাকার উত্তরায় মাইলস্টোন কলেজের ওপর বিমান বিধ্বস্ত, বহু হতাহতের আশঙ্কা

সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ)

দুর্ঘটনাটি কবে এবং কোথায় ঘটেছিল?

দুর্ঘটনাটি ২১ জুলাই ২০২৫, সোমবার দুপুর আনুমানিক ১টা ১৮ মিনিটে ঢাকার উত্তরা দিয়াবাড়ি এলাকায় অবস্থিত মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ঘটে।

দুর্ঘটনার সম্ভাব্য কারণ কী?

প্রাথমিকভাবে যান্ত্রিক ত্রুটিকে দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে ধারণা করা হচ্ছে। তবে, বাংলাদেশ বিমানবাহিনী একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

এই দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা কত?

প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, পাইলটসহ মোট ২০ জন নিহত এবং ১৭১ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন। নিখোঁজদের সন্ধানে উদ্ধারকাজ চলছে।

বিশ্ব নেতারা এ বিষয়ে কী বলেছেন?

ভারত, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক, পাকিস্তান এবং জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা এই মর্মান্তিক ঘটনায় গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করেছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

×